এবারো তালিকাভূক্ত হয়নি তার নামটি। জীবন সাহাহ্নে খুব বেশি চাওয়া নেই তাঁর। স্বাধীনতার ৫২ বছরে এসে মুক্তিযুদ্ধে স্বামী-সন্তানসহ সর্বহারা জোহুরা বেগমের করুণ আকুতি স্বামীর যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও নিজের বীরঙ্গনার স্বীকৃতি। ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীণ পাকিস্তানি সেনাদের হাতে আটক স্বামী আব্দুল সরদার ও ১১ বছরের কিশোরী মেয়ে সুফিয়া খাতুনকে ধরে নিয়ে গেলেও এখনো সন্ধান মেলেনি তাদের। ফিরে আসেনি তারা। স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দিতে আজ পর্যন্ত তাদের খোঁজ নেয়নি কেউ। স্বীকৃতির আশায় সর্বশেষ আবেদনেও সাড়া মেলেনি তাঁর। তবে আশাহত হননি তিনি। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এখনো অপেক্ষায় আছেন ফিরে আসবে তার স্বামী-সন্তান। হয়তোবা সরকারের সংশ্লিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সদিচ্ছায় সিকৃতি মিলবে তাদের।
স্বামী আব্দুল সরদার মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতে ট্রেনিং শেষে দেশে ফেরার পথে ধরা পড়েন পাক বাহিনীর হাতে এরপর, স্বামীর মৃত্যুর খবরে সন্তানদের নিয়ে দেশে ফেরার পথে মেয়েকে ছিনিয়ে নেয় খান সেনারা। সাথে থাকা এক ভাই আজগর সরদার বোনকে উদ্ধারে খান সেনাদের পিছু নিলে সেও গুলিদ্ধি হয়। এরপর কেটে গেছে ৫২ টি বছর। তবু ফিরে আসেনি স্বামী কিংবা মেয়ে। তারপরও অপেক্ষার পালা শেষ হয়নি বয়োবৃদ্ধা জোহুরা বেগমের।
স্বাধীনতার ৫২ বছরেও কেউ খোঁজ নেয়নি তাঁর। খবর রাখেনি কোন সরকার কিংবা মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের কেউ। জীবনের পড়ন্ত বেলায় কেবল শৈশব-কৈশর কিংবা দাম্পত্য সর্বোপরী যুদ্ধকালীন লোমহর্ষক মর্মান্তিক বিভীষিকাময় দিনগুলোর স্মৃতি হাতড়ে সময় কাটে তাঁর। সরকারের কাছে স্বীকৃতি চান স্বামী ও সন্তান হারা হতভাগা মা বীরাঙ্গনা জোহুরা বেগম।
যুদ্ধকালীন নির্মম বিয়োগান্তক ঘটনার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী জোহুরার করুণ আর্তি, জীবনের শেষ সময়ে স্বামীর যুদ্ধাত মুক্তিযোদ্ধা ও নিজের বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি চোখে দেখে যেতে চাই। ভাঙ্গা ভাঙ্গা কান্নামেশানো গলায় কথাগুলো বলছিলেন তিনি। যুদ্ধকালীণ বলা-না বলা কথা মালার বর্ণনা দিতে গিয়ে খানিকটা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল তাঁর। কথোপকথনের মধ্যে একাধিকবার মূর্ছা যান বয়োবৃদ্ধা শহীদ এ মুক্তিযোদ্ধা পতœী।
১৯৭১ সাল। চারিদিকে শুরু হয়ে গেছে মুক্তিকামী মানুষের সাথে পাক বাহিনী ও তাদের দোসরদের তুমুল লড়াই। প্রান্তর জুড়ে প্রতিরোধ। গোটা দেশ যেন রণক্ষেত্র। বাড়ছে লাশের মিছিল। সর্বহারা উদ্বাস্তুর সারিও প্রসারিত হচ্ছে। সেদিন মুক্তিকামী দামাল ছেলেদের কাতারে নিজের নামটিও সংযুক্ত করেন, সাতক্ষীরার তালা উপজেলার খলিলনগর ইউনিয়নের মহন্দীর নিভৃত পলীর মৃত কাতার আলী সরদার ও গুলজান বিবির ছেলে তৎকালীণ স্থানীয় ওয়ার্ড ইউপি সদস্য আব্দুল সরদার। স্ত্রী-সন্তানদের ফেলে স্বাধীনতাকামী দামালদের সাথে ট্রেনিং নিতে তিনিও চলে যান ভারতে।
এব্যাপারে সাতক্ষীরার তালা থানার বীর মুক্তিযোদ্ধা অমলকান্তি ঘোষের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি ভারতের বসিরহাট পিপা ক্যাম্প থেকে বিহার-চাকুলিয়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে টেনিং নেন। তার র্যাঙ্ক ছিল এফ এফ। তার মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং হেড কোয়ার্টার ছিল কল্যাণী। সেখান থেকে সেক্টর অনুযায়ী বাংলাদেশকে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। তিনি মেজর জলিলের অধিনে ৯নং সেক্টরে যুুুুুুুুুুুুুুুুুুুদ্ধ করেন। অন্যদিকে আব্দুল সরদারসহ অন্যরা বসিরহাটের টাকী ক্যাম্প থেকে ট্রেনিং নিয়ে ৬/৭ জন বাংলাদেশে ফেরার পথে সাতক্ষীরার বিনেরপোতা এলাকায় পৌছালে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আলাউদ্দীন জোয়াদ্দার (সাবেক ডেপুটি কমান্ডার), মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, তালা উপজেলা শাখা বলেন, তিনি শুনেছেন ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন তালার আলী আহমদ, আব্দুল সরদারসহ আরো ৬/৭ জন ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরার পথে সাতক্ষীরার বিনেরপোতা এলাকায় পৌছালে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ে। এরপর থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তালা উপজেলা শাখার কমান্ডার মোঃ মফিজ উদ্দীন বলেন, আলী আহমদ, আব্দুল সরদার, মুনতাজসহ আরো কয়েকজন মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরার পথে সাতক্ষীরার বিনেরপোতা এলাকায় পৌছালে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ে। এরপর তাদেরকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়ে সেখানে জিজ্ঞাসাবাদের পর বয়স বিবেচনায় মুনতাজকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ধারণা করা হয়, নির্মম নির্যাতন শেষে অন্যদের সাথে খুলনার গল্লামারী নিয়ে তাদেরকে হত্যা করা হয়।
সর্বশেষ মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভূক্তি হতে যুদ্ধাহত আব্দুল সরদারের স্ত্রী সর্বহারা জোহুরা বেগম মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেন। তবে তালা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি তাদের সাক্ষাৎকার নিলেও নাম ওঠেনি তালিকায়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ৩ জন মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যয়ন বা স্বাক্ষী চাইলেও পরে বলা হয়, লগবেনা। তিনি প্রতিবেদন পাঠিয়ে দেবেন। তবে তিনি প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন কিনা কিংবা পাঠালেও কি লেখা ছিল প্রতিবেদনে তা জানা হয়নি আজও।
আব্দুল সরদারের মেঝ ছেলে আজগর সরদার জানান, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী তারা জানতে পারেন, অন্যদের সাথে তার আব্বাকে পাকিস্তানি আর্মিরা ধরে নিয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদের পর নির্মম নির্যাতন শেষে অন্যদের সাথে খুলনার গল্লামারী নিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। তবে তখনো খবরটি তাদের কাছে পৌছায়নি।
এর আগে স্বামী মুক্তিযুদ্ধে গেছেন এমন খবরে স্থানীয় স্বাধীনতা বিরোধীরা তাদের বাড়িতে হামলাসহ পরিবারের সদস্যদের প্রতি নির্যাতন শুরু করে। অগ্নিসংযোগ করে তাদের বসত-বাড়িতে। এক পর্যায়ে নিরুপায় হয়ে তার স্ত্রী জোহুরা ২ ছেলে আজগর, রহমত ও ৪ মেয়ে আছিয়া, রশিদা, সুফিয়া ও সাহিদাকে নিয়ে ভারতে পাড়ি জমান। সেখানে আশ্রয় নেন শরনার্থী শিবিরে। সেখানে অবস্থানকালীণ কিছু দিন পর লোক মারফত খবর পান তার স্বামী পাকিস্তানীদের হাতে ধরা পড়েছে।
এমন খবরে সেখান থেকে তড়ি-ঘড়ি করে সন্তানদের নিয়ে বেনাপোল বন্দর হয়ে সাতক্ষীরার উপর দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে তারাও ধরা পড়ে পাকিস্তানীদের হাতে। এসময় পাক সেনারা তার কাছ থেকে তার (সেঝ) সুন্দরী কিশোরী মেয়ে সুফিয়াকে (১১) ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় তার মেঝ ছেলে আজগর বোনের পিছু নেয়। এসময় তারা তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। এতে একটি গুলি তার ডান হাত ও আরেকটি পাশ ঘেঁষে চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। মূমুর্ষ অবস্থায় সকলে যখন তাকে নিয়ে ব্যস্ত ততক্ষণে বোন সুফিয়াকে নিয়ে হায়েনারা চলে যায় অজানা গন্তব্যে। তারপর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি, ফিরেও আসেনি সে। হয়তোবা তাদের পাশবিক নির্যাতনে এক সময় সেও মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিল।
এরপর দেশ স্বাধীনের বছর খানেক পর জোহুরা ও তার সন্তানরা লোক মারফত নিশ্চিত হয় তাদের বাবা ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফেরার পথে ধরা পড়ে শহীদ হন। অথচ স্বাধীনতার ৫২ বছরেও তাদের খোঁজ রাখেনি কোন সরকার। খবর নেয়নি মুক্তিযোদ্ধা কিংবা সংশ্লিষ্ট সংগঠনের কেউ।
আব্দুল সরদারের নাতনী খুলনার পাইকগাছার কাশিমনগরের ইসহাক আলী মোড়লের মেয়ে লিলিমা খাতুন বলেন, শৈশব থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধে তার নানা, খালা-মামাদের উপর ঘটে যাওয়া নির্মম বর্ণনা শুনতে শুনতেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। গল্প শুনে যুদ্ধকালীণ বিভীষিকাময় ঘটনা মুখস্ত হয়ে গেছে তার। নানী, মা, মামা-খালাদের পাশাপাশি তারও দাবি, মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাাঁথায় আঁচড় পড়ুক তাদের নামগুলিও।
তিনি আরও জানান, বীরঙ্গনা কাকে বলে ঠিক জানেন না। তবে যুদ্ধকালীন সর্বহারা নারীকে বীরঙ্গনার মুকুট দিলে তার খালা সুফিয়াও নিজেকে বিসর্জন দিয়ে বিজয়ীনী লাল-সবুজের পতাকায় নিজের নামটিও লিখে গেছেন।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর পর কোন বিশেষ স্বার্থে নয়, এমনকি কোন ভাতা বা ভিন্ন উদ্দেশ্যে নয়, তাঁরা চান ন্যুনতম সম্মান।
আব্দুল সরদারের মেঝ ছেলে ভ্যান চালক আজগর সরদার বলেন, তিনি যুদ্ধ করেননি, তবে গর্বের সাথে বীরের ছেলে বলে নিজেকে দাবি করেন। সেদিন দেশে ফেরার পথে পাকিস্তানীদের হাত থেকে নিজের বোনকে বাঁচাতে নিজেও গুলিবিদ্ধ হন। তিনি দাবি করেন, পিতার মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে গত ৫০ বছরে তার মা জোহুরা বেগম কারো সাথে খুব বেশী কথা বলেন না। তবে মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনলে এখনো আঁৎকে উঠেন। স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে এখনো অপেক্ষা করেন, স্বামী ও মেয়ের ফিরে আসার। কখনো নিরাশ হয়ে আবারো চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন অঘোরেু। হয়তো স্বামীর বীরত্বগাঁথায় এখনো নিজেকে গর্বিত অনুভব করেন এ বীরাঙ্গনা।
জোহুরা বেগম বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পর থেকে এখনো পর্যন্ত স্বামী-সন্তানের অপেক্ষায় রয়েছেন। তাঁর বিশ্বাস, হয়তোবা ফিরে আসবে তাঁরা। তাদেরকে যে, এখনো অনেক কথা বলার বাকি আছে তাঁর।
ওয়েবসাইট নকশা প্রযুক্তি সহায়তায়: ইন্ডিপেন্ডেন্টবিডি আইটি টিম