মিজানুর রহমান মিলন, সৈয়দপুর ::
ছিলেন ক্রিকেটার। এখন সফল শিল্প উদ্যোক্তা। অসহায় মানুষজনের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি মানবসেবা করতে এগিয়ে চলেছেন নিজ উদ্যোগে। পাশাপাশি ঝিমিয়ে পড়া স্থানীয় ক্রিকেটের উন্নয়নেও কাজ করে চলেছেন তিনি। এখন এক কথায় বলা যায় এসব তাঁর নেশায় পরিণত হয়েছে।
করোনাকালেও অসহায় মানুষজনের পাশে দাড়িয়ে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি। সেই জনপ্রিয় ব্যক্তি হলেন হুমায়ুন কবির। বয়স ৪০ এর ঘরে। বাড়ি নীলফামারী জেলার শিক্ষানগরী খ্যাত ব্যবসা প্রসিদ্ধ উপজেলা সৈয়দপুরের নতুন বাবুপাড়া এলাকায়।
স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি ক্রিকেটের প্রতি দূর্বল ছিলেন হুমায়ুন। বিশ্বের সেরা ক্রিকেটারদের খেলা দেখে তাঁরও ইচ্ছে জাগে ক্রিকেটার হওয়ার। যেমন ইচ্ছা, তেমন কাজ। তারপর থেকে তাঁকে আর ফিরে তাঁকাতে হয়নি। নিয়মিত খেলতে থাকায় হয়ে ওঠেন অলরাউন্ডার। বাঁহাতি অফস্পিন বোলার এবং চমৎকার ফিল্ডিং আর ব্যাটিংয়ে তাঁর দলকে জিতিয়েছেন বহুবার।
ক্রিকেট খেলা অবস্থায় ক্রিকেটের আয়ের একটি অংশ খরচ করে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন মানবসেবায়। পাশাপাশি সিদ্ধান্ত নেন ব্যবসা করার। এ অবস্থায় তাঁর ঘনিষ্ঠ এক ক্রিকেটার বন্ধুর সহযোগিতায় নিজের অর্থ দিয়ে শুরু করেন ক্ষুদ্র ব্যবসা। তাঁর নিষ্ঠা আর সততায় ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এক সময়ের জনপ্রিয় ক্রিকেটার হুমায়ুন কবিরের ব্যবসা। গড়ে তোলেন এটলাস কসমেটিকস লিমিটেড কোম্পানি নামে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে তাঁর এ শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বেকারত্ব ঘুচেছে পাঁচ সহস্রাধিক নারী পুরুষের।
সৈয়দপুর পৌর এলাকার নতুন বাবু পাড়ার বাসিন্দা মো. হারুন উর রশিদের পুত্র হুমায়ুন। স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি ক্রিকেটের সাথে যুক্ত হয়ে খেলা শুরু করেন আশির দশকের শেষের দিকে । সৈয়দপুরের প্রথম সারির ক্রীড়া সংগঠন ন্যাশনাল ক্রিকেট ক্লাবে নাম লেখান তিনি। শহরের রেলওয়ে মাঠে বোলিং ও ব্যাটিংয়ের জন্য অনুশীলন করতে থাকেন। সে সময় ক্লাবের অন্যান্য খেলোয়াড়রাই নিজেদের মধ্যে বোলিং ও ব্যাটিংয়ের প্রাকটিসে সহযোগিতা করতেন। এভাবে তিনি ( হুমায়ুন) নিজেকে গড়ে তোলেন বাঁ হাতি স্পিন বোলার ও মারকুটে ব্যাটসম্যান হিসেবে। চমৎকার ফিল্ডিংও করতেন তিনি। তাঁর এ প্রতিভার কারণে সে সময় নির্মাণ স্কুল ক্রিকেটে অলরাউন্ডার খেলোয়াড় হিসেবে সংশ্লিষ্টদের নজরে আসেন। স্কুল ক্রিকেটে কোচের পছন্দের তালিকায় থাকতেন সকলের শীর্ষে। পাশাপাশি নিজের ক্লাবসহ সৈয়দপুরের বাইরের ক্লাবের পছন্দের খেলোয়াড় হিসেবে সেরা একাদশে থাকতেন।
১৯৯৩ সালে এএসসি পরীক্ষায় সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হন তিনি। পরে সৈয়দপুর, দিনাজপুর,রংপুর,ঈশ্বরদী, লালমনিরহাট, জয়পুরহাট, বগুড়াসহ বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করেন হুমায়ুন। তখন থেকে ঢাকায় কোন এক ক্লাবের হয়ে খেলার আশায় কঠোর অনুশীলন চালিয়ে যান স্থানীয় রেলওয়ে মাঠে। সফলতাও আসে অনুশীলনের। ডাক পান নীলফামারী জেলা থেকে প্রথম শ্রেনির ক্রিকেট দল রাজশাহী বিভাগের হয়ে খেলার। সেখানে ২০০০ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত একটানা খেলেন বাহাতি এই ওপেনার হুমাযুন কবীর। তিনি প্রথম শ্রেণীর ২৫ টি ম্যাচে ৯২৯ রান ও লিস্ট-এ ১৬ ম্যাচে করেন ১৯৭ রান। ওই দুই শ্রেণীর ক্রিকেটে স্পিন বোলার হিসেবে হাত ঘুরিয়ে ১৮ টি উইকেট নিজের ঝুলিতে নেন।
এরপর থেকেই ঢাকার বিভিন্ন ক্লাব কর্মকর্তাদের নজরে আসেন তিনি। সেখানে দ্বিতীয়, প্রথম ও প্রিমিয়ার লীগে বিভিন্ন দলে প্রায় ১৬ বছর খেলেন। ঢাকার কাঠাল বাগান, উত্তরা, যাত্রাবাড়ি, ওয়ারি ক্লাবে খেলা চালিয়ে যান। পরে প্রিমিয়ার লীগে ইন্দিরা রোড, বাংলাদেশ বিমান, ব্রাদার্স ইউনিয়ন, কলাবাগানসহ বিভিন্ন ক্লাবে খেলেন। তাঁর ঘূর্ণি বল, ফিল্ডিং নৈপুণ্য ও ব্যাটিং তান্ডবের কারণে জাতীয় ক্রিকেট দলের কর্মকর্তাদের নির্বাচকদের নজরে আসেন তিনি। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয় – এ দলের হয়ে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান সফর করেন। ওই দুই দেশেই দুটি হাফ সেঞ্চুরি করেন। এরপরেই তাঁর ভাগ্যে সফলতা আসতে থাকে। সংগঠক এবং প্রথম শ্রেণীর খেলোয়াড় হিসেবে জাতীয় ক্রিকেট লীগে বরিশাল ফরচুনেরও পৃষ্ঠপোষকতা করার পাশাপাশি প্রিমিয়ার ক্রিকেটে ধুঁকতে থাকা ব্রাদার্স ইউনিয়নের হাল ধরেন হুমায়ুন।
বর্তমানে তাঁর নিজ জেলা নীলফামারীর ক্রিকেট ওয়েলফেয়ারের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নতুন ক্রিকেটার তৈরীর জন্য নিজ অর্থায়নে গড়ে তোলেন ন্যাশনাল ক্রিকেট একাডেমি। বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের অপরিহার্য ক্রিকেটার মারুফার হাতে খড়ি হয় ন্যাশনাল ক্রিকেট একাডেমির মাধ্যমে। এছাড়া এ নীলফামারীর জেলা বয়সভিত্তিক দল, দুরন্ত রাজশাহী দলের উপদেষ্টা ও সৈয়দপুরে চলমান সৈয়দপুর প্রিমিয়ার লীগ (এসপিএল) সিজন-২ এর পৃষ্ঠপোষকতাসহ উত্তর জনপদে বিভিন্ন ক্রিকেট টূর্ণামেন্ট আয়োজনেও ব্যাপক ভুমিকা রাখছেন। এখন তাঁর উদ্দেশ্য কেবল তরুনদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি মেধাবী ক্রিকেটার তৈরী করা। যারা নীলফামারী জেলা ছাড়াও উত্তর জনপদের সুনাম কুড়িয়ে দেশে ছড়িয়ে দিতে পারে। আর এসব করতে অর্থ যোগান দিচ্ছেন তিনি নিজেই। তাঁর গড়ে তোলা এটলাস কসমেটিকস লিমিটেডের কোম্পানির আয়ের একটি অংশ থেকে ক্রিকেটের উন্নয়ন এবং মানবসেবায় ব্যয়,করা হচ্ছে। হুমায়ুন কবির বর্তমানে ঢাকার ফারুক আহমেদ স্মরণি নিকুঞ্জ-২ খিলখেতের প্রধান কার্যালয় থেকে পরিচালনা করছেন উৎপাদনমুখী ব্যবসা। তাঁর শিল্পের উৎপাদন করা পণ্য বাজারজাত করতে দেশের প্রতিটি জেলায় নিজস্ব ডিলারের মাধ্যমে কাজ করছেন শতশত শিক্ষিত যুবসমাজ। মানব ও সমাজসেবী হুমায়ুন ব্যবসার পাশাপাশি নীরবে চালিয়ে যাচ্ছেন সমাজ সেবামুলক নানা কর্মকাণ্ড। তিনি মহামারি করোনাকালে ঘরে বন্দি থেকে কর্মহীন হয়ে পড়া হাজার হাজার মানুষের মাঝে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য, পোশাক ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করেছেন। একইসাথে অসহায়,মানুষজনের চিকিৎসা, দূস্থ পরিবারের মেয়েদের বিয়েতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছেন এবং বর্তমানেও অব্যাহত রেখেছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ সুত্র জানিয়েছে হুমায়ুন মানবসেবায় নিজেকে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত রাখতে গ্রহণ করেছেন নানামুখী পদক্ষেপ। এজন্য শত ব্যস্ততার মাঝেও বাবা মো: হারুন অর রশিদসহ মা, বোন, আত্মীয়স্বজন ছাড়াও এলাকার ক্রিকেটের খবর নিতে প্রায় ছুটে আসেন নিজ এলাকায়। খোঁজ খবর নেন অসহায় মানুষজনের।
এ প্রসঙ্গে সৈয়দপুরের বাসিন্দা জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক উইকেট কিপার মুখতার সিদ্দিকী বলেন, মহান আল্লাহ হুমায়ুনের মতো যোগ্য লোককেই সামর্থ্য দান করেছেন। যা মানবসেবায় আয়ের একটি অংশ ব্যয় করছেন। এখনও তিনি ২২ গজের মায়া ছাড়তে পারেননি। সুযোগ পেলেই ব্যাট হাতে ছুটে যান মাঠে। এখনও তিনি কর্পোরেট লীগে বিভিন্ন দলের সাথে চুক্তিতে খেলছেন।
কথা হয় সাবেক ক্রিকেটার ও ন্যাশনাল ক্রিকেট ক্লাবের কর্মকর্তা জাহিদ আলমের সাথে। তিনি বলেন, হুমায়ুন আমাদের সৈয়দপুরের গর্ব। তিনি ব্যবসার কাজে ঢাকায় অবস্থান করলেও তার মন পড়ে থাকে সৈয়দপুরে। তিনি এলাকার অসহায় মানুষের পাশে থাকতে বদ্ধ পরিকর। এজন্য নিয়মিত খোঁজ খবর নেন তিনি। পাশাপাশি ক্রিকেটের উন্নয়নে রাখছেন বলিষ্ঠ ভুমিকা। তিনি বলেন হুমায়ুনের মতো যদি সবাইএগিয়ে আসতো তাহলে সৈয়দপুরে ক্রিকেটের একাধিক টূর্ণামেন্ট আয়োজন করা হবে। আর নিয়মিত খেলা হলে আমাদের সৈয়দপুর থেকে তৈরী হরে একাধিক ক্রিকেটার।
সম্প্রতি সফল ব্যক্তি হুমায়ুনের বাসভবনে কথা হলে তিনি তাঁর সফলতার বিষয়ে বিভিন্ন কথা বলেন। চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার মাঝে মাঝেই তুলে ধরেন উপরে ওঠার বিভিন্ন ধাপের ইতিহাস।
হুমায়ুন বলেন, ২০০৭ সালে জাতীয় ক্লাব কাপ ক্রিকেটে নিজের ন্যাশনাল ক্রিকেট ক্লাবকে চ্যাম্পিয়ন করি। অলরাউন্ডিং পারফর্মেন্সের কারণে ওই টুর্ণামেন্টের ফাইনালে ম্যান অব দ্যা ম্যাচ নির্বাচিত হয়েছিলাম। তবে ইংল্যান্ডের মাইনর ক্রিকেট লীগে দুই বছর খেলার পর উৎপাদনমুখী ব্যাবসায় ঝুকে পড়েন এ ক্রিকেটার। ক্রিকেটার বন্ধু মোশাররফ হোসেন রুবেলের সহযোগিতায় ঢাকার বিসিকে সামান্য জায়গায় গড়ে তোলেন এটলাস কসমেটিকস নামে শিল্প কারখানা। সেখানে ডিটারজেন্ট, কয়েল, স্যানিটাইজার, ডিসবার, হ্যান্ডওয়াশ, এন্টিসেপটিকসহ ২৯ টি পণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে। ওইসব পণ্য বাজারে ব্যাপক চাহিদা থাকায় বৃদ্ধি পায় ব্যবসার পরিসর। এ অবস্থায় তাঁর প্রতিষ্ঠানটি বিসিক থেকে সরিয়ে নারায়নগঞ্জ জেলার রুপগঞ্জের মাসুমাবাদের হাটাব হান্ডিয়াল এলাকায় স্থানান্তর করেন। ৪ বিঘা জমির উপর নির্মাণ করা ওই প্রতিষ্ঠানে রয়েছে অত্যাধুনিক মেশিনপত্র, উৎপাদিত পণ্যের মান যাচাই ও নির্ধারণের জন্য পরীক্ষাগার (ল্যাব), কনফারেন্স কক্ষসহ অন্যান্য স্থাপনা। তিনি বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত প্রতিটি পণ্যের গুনগত মান ঠিক রাখতে সার্বক্ষণিক তদারকি করা হয়। তার উৎপাদিত পণ্য দেশের ৫০টি জেলায় ডিলারের মাধ্যমে বাজারজাত হচ্ছে। এদিকে তাঁর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যের মান ভালো হওয়ায় দেশের স্বনামধন্য বেশ কেয়কটি কোম্পানির পণ্য চুক্তিতে তৈরি করা হয় তার প্রতিষ্ঠান থেকেই।
তিনি বলেন, আল্লাহতায়ালার অশেষ রহমতে আমি ভালো আছি। আমার মতো আমার অধিনস্ত কর্মকর্তা কর্মচারিসহ সবাই যাতে ভালো থাকে সে চেষ্টাও করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, আমার বাকি জীবনটা যেন মানুষের সেবায় নিয়োজিত রাখতে পারি, সেজন্য সকলের দোয়া চাই। ক্রিকেট প্রসঙ্গে হুমায়ুন বলেন, সৈয়দপুরসহ উত্তর জনপদের ক্রিকেটকে আরও বেগবান করতে সব ধরণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমি যেখানেই থাকি ক্রিকেটের জন্যও কাজ করে যাবো।
এ নিয়ে সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি মো: নুর-ই- আলম সিদ্দিকী বলেন, হুমায়ুনের মত শিল্প উদ্যোক্তা ও পৃষ্ঠপোষক খুবই দরকার। তাহলে পরিকল্পিতভাবে সৈয়দপুরসহ গোটা জেলায় ক্রিকেটকে আরও এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। এজন্য তার পক্ষ থেকেও সহযোগিতা থাকবে বলে জানান তিনি।