মিজানুর রহমান মিলন, সৈয়দপুর::
দুইদিন থেকে মেয়ের কোন খোঁজ মিলছিলো না। অসহায় মা ফারজানা বেগম (৬০) তার ছোট মেয়ে রুকসি বেগমকে (২৩) নিয়ে হন্যে হয়ে বিভিন্ন জায়গায় মেয়ের খোঁজ শুরু করেন।
কোথাও না পেয়ে মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর ) থানায় জিডি করার জন্য প্রস্তুতি নেন। হঠাৎ বিকেলে শহরের শেরে বাংলা সড়কের শেরু হোটেল মোড়ে দেখা মেলে জামাতা জাহাঙ্গীরের (৩৫)। তখন তারা শবনম কোথায় জানতে চাইলে তাঁর বোনের (শবনমের) বাসায় আছে বলে সে পালিয়ে যায়।
পরে জাহাঙ্গীর তাঁর শ্যালিকা রুকসিকে ফোন করে জানায় তার বোনকে মেরে ফেলেছে। লাশ নয়াবাজারের ভাড়া বাসার একটি রুমে আছে।
লাশটি নিয়ে যেতে বলে এবং সে নাকি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করবে। পরে তাঁর দেওয়া তথ্য পেয়ে পুলিশের উপস্থিতিতে সৈয়দপুর শহরের নয়াবাজার গোয়াল পাড়া এলাকার ওই ভাড়া বাড়ির তালাবদ্ধ ঘর থেকে গৃহবধূ শবনম আক্তারের (২৮) মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
নিহতের বোন রুকসি জানায়, প্রথমে ভেবেছিলাম আমার বোনের স্বামী জাহাঙ্গীর ঠাট্টা করছে। কিন্তু তার কথাটিই যে সত্য হবে তা আমরা কখনও চিন্তাও করিনি। তিনি ঘাতক জাহাঙ্গীরের শাস্তি চান।
পুলিশ ও নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার ভবানীপুরের (বর্তমানে সৈয়দপুর উপজেলার বাঙালিপুর ইউনিয়নের পীরপাড়ার বাসিন্দা) মৃত আব্দুর রহমানের মেয়ে শবনম। তাঁর আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল। মাদরাসায় পড়ুয়া ১১ বছর বয়সী তাঁর এক মেয়ে রয়েছে তার। ৭/৮ বছর আগে পূর্বের স্বামী সঙ্গে বনিবনা না হওয়া মায়ের বাড়িতে চলে আসেন তিনি (শবনম)। এরই মধ্যে শহরের মুন্সিপাড়া দর্জিপট্টি এলাকার মমতাজ উদ্দিনের ছেলে চটপটি ও ফুচকা ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে শবনমের ভালাবাসা সম্পর্ক গড়ে উঠে। মাস দেড়েক আগে বিয়েও করেন তারা। যদিও তাঁর দ্বিতীয় স্বামী জাহাঙ্গীর আলমের আগের স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে। গত সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) দুপুরে ওই দম্পতি শহরের নয়াবাজার গোয়ালপাড়া এলাকার আক্তারী বেগমের বাড়ীর একটি ঘর ভাড়ায় নেয়। পরদিন মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) শবনমের বোন ও মা তাঁর খোঁজে বের হয়। কিন্তু শবনমের মুঠোফোনবন্ধ থাকায় তাঁর খোঁজ মিলছিল না। শবনম নিখোঁজের ঘটনায় তাঁর পরিবার থানায় জিডির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ অবস্থায় গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢেলাপীর থেকে ফেরার পথে শেরে বাংলা সড়কের শেরু হোটেলের সামনে দেখা মেলে জাহাঙ্গীরের। এসময় শবনম কোথায় জানতে চাইলে সে জানায় শবনম তার বোনের (জাহাঙ্গীরের আরেক শ্যালিকা) বাসায় আছে বলে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। শবনমের ছোট বোন রুকসি বেগম দুলাভাই জাহাঙ্গীর আলমের মোবাইল ফোনে কল করলে দুলাইভাই জাহাঙ্গীর বলেন, তোর বোনকে মেরে ফেলে রেখেছি। শহরের গোয়ালপাড়া ভাড়া বাসা গিয়ে লাশ নিয়ে যা। পরে তার দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে দেখেন ভাড়া বাসায় তালাবদ্ধ ঘরে বড় বোনের লাশ খাটের ওপর লেপ দিয়ে মোড়ানো অবস্থা পড়ে আছে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসেন সৈয়দপুর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ কে এম ওহিদুজ্জামান ও থানার অফিসার ইনচার্জ ফইম উদ্দিনসহ পুলিশের একটি দল। পরে নিহতের মা, বোন আত্মীয়স্বজনসহ এলাকাবাসীর উপস্থিতিতে পুলিশ ঘরের তালা ভেঙ্গে গৃহবধূর মরদেহ উদ্ধার করেন। সেখানে মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরী শেষে লাশ থানায় আনা হয়।
বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) সকালে ময়নাতদন্তের জন্য নিহতের মরদেহ নীলফামারী মর্গে পাঠানো হয়।এ ঘটনার পর থেকে শবনমের স্বামী জাহাঙ্গীর গা ঢাকা দিয়েছে।
গৃহবধূর মা ফারজানা বেগম বলেন, জাহাঙ্গীর মেয়েকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করত। সম্প্রতি যৌতুকের জন্য চাপ দিলে এনজিও থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তার হাতে দেন তিনি। জাহাঙ্গীর ওই টাকা দিয়ে ব্যবসা না করে নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। আর নেশা করতে বাঁধা দেওয়ায় তাঁর মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
সৈয়দপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. ফইম উদ্দিন বলেন, খবর পেয়ে তালা ভেঙ্গে লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলেই গৃহবধূর হত্যার কারণ জানা যাবে। আর গৃহবধূর স্বামী জাহাঙ্গীর আলমকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।