শেখ নাদীর শাহ্ ::
শুরুতে আবহাওয়ার প্রতিকূল পরিবেশেও খুলনার পাইকগাছায় চলতি বছর আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রান্তর জুড়ে সোনালী ধানের সমারোহ জানান দিচ্ছে বাম্পার ফলনের সুবাতাস। অতিবর্ষায় বীজতলা নষ্ট হওয়ায় দেরীতে রোপন শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত আবহাওয়ার কোন রকম চোখ রাঙানি ছাড়াই কৃষকের ঘরে উঠছে ধান। তৃণমূলে কৃষকের ঘরে এখন ধান কর্তন ও মাড়াইয়ের ব্যস্ততা। চলতি বছর উপজেলায় আমনের আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৭ হাজার ৪ শত ২৫ হেক্টর। তবে প্রাকৃতিক দূর্যোগে সৃষ্ট নানা প্রতিকূলতায় বীজতলা থেকে শুরু করে জলাবদ্ধতায় আবাদ হয়েছে ১৫ হাজার ৪ শত ২৫ হেক্টর। তবে প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমিতে কম আবাদ হলেও উৎপাদন ভাল হওয়ায় ক্ষতি পুষিয়ে তুলতে পারবেন কৃষকেরা, এমনটাই প্রত্যাশা কৃষকের পাশাপাশি কৃষি বিভাগের।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সরজমিনে ঘুরে কৃষকসহ কৃষি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানাযায়, ইতোমধ্যে উপজেলা জুড়ে আমনের ধান কর্তন শুরু হয়েছে। অপেক্ষাকৃত উঁচু ক্ষেতে আমন ধান কর্তন ও সংরক্ষণ প্রক্রিয়া শেষে কৃষক রবি শষ্য বুননও শেষ করেছেন। তবে অপেক্ষাকৃত নীচু ও মাছের ঘেরাঞ্চলের আমন ক্ষেত সমূহে ধান কর্তনে অপেক্ষা করতে হবে আরো কিছু দিন। যদিও কৃষকের দাবি, আগামী দু’তিন সপ্তাহের মধ্যে সেসব এলাকার ধান কর্তন শেষ হবে।
উপজেলা কৃষি বিভাগ বলছে, ইতোমধ্যে উঁচু ক্ষেতের প্রায় ৭ হাজার হেক্টর জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে বাকি ধান কর্তন শেষ হবে বলেও জানান কৃষি বিভাগসহ কৃষির সাথে সংশ্লিষ্টরা।
উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, উপকূলীয় এ অঞ্চলের ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধগুলো দীর্ঘ দিন যাবৎ সংষ্কার না হওয়ায় অতিবৃষ্টি কিংবা জোয়ারের উপচেপড়া পানিতে বাঁধ ভেঙ্গে পোল্ডার অভ্যন্তরে পানি ঢুকে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে উপজেলার দেলুটির ২২নং পোল্ডার জুড়ে কৃত্রিম বন্যার মুখে পড়ে। বিশেষ করে সেখানকার কৃষি মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে।
স্থানীয়রা জানান, উপজেলার প্রাণ-প্রকৃতি ও কৃষি জড়িয়ে রয়েছে খাল-বিল, নদী-নালার সাথে। এক সময়ের কৃষিবান্ধব পাইকগাছার সবচেয়ে বড় বাঁধা বিলের পলিভরাটি বদ্ধ নদ-নদী ও খাল গুলো। দীর্ঘ দিনেও সেগুলো খনন না করায়, দখল-দূষণের পাশাপাশি কেড়ে নিচ্ছে কৃষির উপযোগী পরিবেশ।
নাব্যতা হ্রাসে নদীর পলিভরাটি বিস্তীর্ণ জমির বেদখল, খাল সমূহের ইজারাদারের দৌরাত্ম, নেটপাটা দিয়ে মাছ চাষ, যত্রতত্র বাঁধসহ অতিবৃষ্টিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় কৃত্রিম জলাবদ্ধতায় সৃষ্ট প্রতিকূলতায় কৃষকরা সময় মত আমনের আবাদ করতে পারেনি। স্থানীয়রা কিছু ক্ষেতে সেচ দিয়ে আগাম চারা রোপন করেছিল আবার দেরিতে প্রচুর বৃষ্টি হওয়ায় নাবিতে কিছু এলাকায় আবাদ হয়েছে। কৃষকরা জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অন্যান্য এলাকার চেয়ে উপকূলীয় অঞ্চলে অন্তত এক মাস পরে আমনের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয়।
প্রকৃতির বৈরিতার পাশাপাশি লোনা পানির লিজ ঘের গুলোতে সেচ’র কাজ সেরে দেরিতে আমনের ক্ষেত প্রস্তুত করে আবাদ করা হয়। সে জন্য আমন ধনি কর্তসও শুরু হয় দেরিতে। তবে এতকিছুর পরও উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন ধানের বাজার মূল্য ভাল থাকায় কৃষকেরা খুশী। নতুন আমন ধান মন প্রতি সাড়ে ১৪শ টাকা থেকে সাড়ে ১৫শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত ধানের বিচুলীর চাহিদা গগণচুম্বি থাকায় আমনের আবাদে কৃষকের আগ্রহ ক্রমশ কেড়েই চলেছে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এ মৌসুমে উপজেলার ১টি পৌরসভা ও ১০টি ইউনিয়নে আমনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৭ হাজার ৪ শত ২৫ হেক্টর। অতিবৃষ্টিতে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলাবদ্ধতায় বর্তমানে গত খরিপ ২ মৌসুমে ১৫ হাজার ৪ শত ২৫ হেক্টর জমিতে রোপা আমনের আবাদ হয়। এর মধ্যে উপজেলায় উঁচু ক্ষেতে আবাদকৃত প্রায় ৭ হাজার হেক্টর জমির ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। কর্তনকৃত ধানের হেক্টর প্রতি ফলন হাইব্রিড ৫.৯ মেট্রিকটন ও উফশী ৫.৬ মেট্রিকটন হারে ফলন পাওয়া যাচ্ছে। আর নাবিতে লাগানো ক্ষেতের ৩০ ভাগ ধানে দুধ হয়েছে ও ২২ ভাগ পাকা এবং দানা অবস্থায় আছে।
উপজেলার গদাইপুর ইউনিয়নের হিতামপুর ব্লকের কৃষক আলাউদ্দিন, পুরাইকাটী ব্লকের কৃষক ফারুক হোসেন ও তোকিয়া ব্লকের কৃষক শফিকুল জানান, বৈরি আবহাওয়ার পরও তাদের ক্ষেতের আমনের ফলন ভালো হয়েছে।
মটবাটি গ্রামের কৃষক আলাউদ্দিন বলেন, তার মৎস্য ঘেরে আবাদকৃত ক্ষেতের ধানে দুধ এসেছে। কোন কোন ক্ষেতে দোল এসেছে। তাছাড়া মাজড়া পোকার আক্রমণে অতিরিক্ত পরিচর্যা ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেতের ধানে চিটার পরিমানও বেশী দেখা যাচ্ছে। এতে সেখানকার কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
উপজেলার দেলুটি ইউনিয়ন, গড়–ইখালী, রাড়–লী, গদাইপুর ও চাঁদখালী ইউনিয়নের গজালিয়া, মৌখালী, কৃষ্ণনগর, দেবদুয়ার কৃষকরা জানান, কৃষি অফিসের সহায়তায় আমনের আবাদ ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেত। কিন্তু শেষ সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতায় তাদের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আশানুরূপ ফসল হয়নি তাদের। এয়াড়া পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা খাল, নদী ভরাট থাকায় যথাসময়ে এসব এলাকার পানি নিস্কাশন করা সম্ভব হয়নি। তারা খাল ও নদী গুলো খনন এবং ইজারা বন্ধ করে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করারও দাবি জানান তারা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোঃ একরামুল হোসেন জানান, আমনের ফলন ভাল হয়েছে। আবহাওয়ার কারণে কৃষকদের আমন আবাদ শুরু করতে কিছুটা দেরি হলেও পরে প্রচুর বৃষ্টিতে লবণাক্ত মাটি পরিশোধিত হওয়ায় আমনের ফলন ভাল হয়েছে। এছাড়া এ অঞ্চলের কৃষির প্রাণ বেড়িবাঁধ সংস্কার, পানি নিষ্কাশনে খাল ও নদী খননের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অবহিত করা হয়েছে।
এক সময়ের কৃষির সমৃদ্ধ অঞ্চল খ্যাত এ জনপদের মানুষ কৃষি খাতে নতুন করে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে চললেও উপরের নানা প্রতিকূলতা তাদের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কৃষি প্রণোদনা বৃদ্ধির পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত নিচু জমিতে লম্বা জাতের বীজ সরবরাহ নিশ্চিত, খাল ও বদ্ধ নদী খনন, উপকূলীয় এ অঞ্চলে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণসহ সামগ্রিক সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন স্থানীয় কৃষককূল।